১. ভুল ধারণা? শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো সহজ।
মায়ের বুক খুঁজে নেওয়ার প্রবৃত্তি নিয়েই শিশুরা জন্মায়। যাইহোক, অনেক মায়েদের বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য তাদের শিশুর অবস্থান নির্ধারণের এবং তাদের শিশুটি সঠিকভাবে স্তনের সাথে যুক্ত আছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর সহায়তা প্রয়োজন। শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য সময় লাগে এবং এর জন্য মা ও শিশু দু’জনেরই অনুশীলন দরকার হয়। শিশুর যখনই ক্ষুধা লাগে তখনই তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে হয়। সে কারণে বাড়ি ও কাজের উভয় জায়গাতেই সন্তানকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা ও সহযোগিতার প্রয়োজন হয়।
২. ভুল ধারণা? বুকের দুধ খাওয়াতে গেলে আঘাত লাগবেই – স্তনের বোঁটা ক্ষত হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
অনেক মা-ই সন্তান জন্মদানের পর প্রথম কিছুদিন দুধ খাওয়ানোর সময় অস্বস্তি বোধ করেন। শিশুকে সঠিক অবস্থানে রেখে এবং ঠিকমতো স্তনের সাথে যুক্ত রেখে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো গেলে, স্তনের বোঁটার ক্ষত হওয়া বা ফুলে যাওয়া এড়ানো যায়। কোনো মা এ ধরনের সমস্যায় পড়লে স্তনদান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বা দক্ষ পেশাজীবীর পরামর্শ নিয়ে তা কাটিয়ে উঠতে পারেন।
৩. ভুল ধারণা? শিশুকে দুধ খাওয়ানোর আগে স্তনের বোঁটা ধুয়ে নিতে হবে।
শিশুকে বুধের দুধ খাওয়ানোর আগে স্তনের বোঁটা ধুয়ে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। শিশুরা জন্মের পর থেকেই তার মায়ের শরীরের গন্ধ ও কন্ঠস্বরের সাথে পরিচিত হয়ে যায়। তাছাড়া স্তনের বোঁটায় কিছু পদার্থ তৈরি হয় যার ঘ্রাণ শিশুরা পায় এবং তাতে এক ধরনের ভালো ব্যাকটেরিয়াও থাকে। এগুলো শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে।
আপনি কি জানেন? বুকের দুধ শিশুর কানের সংক্রমণ, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করে।
৪. ভুল ধারণা? মায়ের বিশ্রামের জন্য শিশু ও তার মাকে আলাদা রাখতে হয়
ডাক্তার, নার্স ও ধাত্রীরা প্রায়ই জন্মের পরপরই শিশুকে তার মায়ের সংস্পর্শে রাখতে বলেন। একে ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ও বলা হয়। এভাবে মায়ের সংস্পর্শে রাখা, গায়ের সঙ্গে লেগে থাকা শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যা তাদের মায়ের বুকের দুধ খুঁজতে ও পেতে সহায়তা করে। যদি শিশুর জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে তা করা যায় এবং এরপরে বারবার তা করা যায়, তাহলে শিশুরা সহজে দুধ পাবে। যদি মা তা একা না করতে পারেন, তাহলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মা ও শিশুকে সাহায্য করতে হবে।
৫. ভুল ধারণা? শিশুকে দুধ খাওয়ানোর দিনগুলোতেই মাকে শুধু সাধারণ খাবার খেতে হবে।
অন্য সবার মতোই নবজাতকের মাকেও সুষম খাবার খেতে হবে। সাধারণত খাদ্যাভ্যাস বদলানোর কোনো দরকার নেই। কেননা শিশুরা যখন মায়ের পেটে ছিল তখন থেকেই ওই খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব তার ওপর রয়েছে। তারপরও যদি মায়ের মনে হয় তার কোনো খাবারের খারাপ প্রভাব সন্তানের ওপর পড়ছে, তাহলে কোনো একজন শিশু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
৬. ভুল ধারণা? ব্যায়াম দুধের স্বাদ পাল্টে ফেলবে।
ব্যায়াম শরীরের জন্য উপকারী। স্তনদানকারী মায়েদের ক্ষেত্রেও তা একইভাবে সত্যি। ব্যায়াম করলে দুধের স্বাদ পাল্টে যায় এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
৭. ভুল ধারণা? আপনি যদি জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই দুধ না খাওয়ান পরে আর পারবেন না।
শিশুর জন্মের পর এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করাটা সহজ। কারণ এই সময়ে শিশুরা বেশী আগ্রহী থাকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার জন্য। কীভাবে মায়ের বুকের দুধ খেতে হবে তা শেখার জন্য সে এসময় প্রস্তুত থাকে। যদি জন্মের পরপরই শিশুকে দুধ খাওয়াতে না পারেন, তাহলে পরে আপনার অবস্থা অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব খাওয়ানো শুরু করুন। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য ঠিকভাবে তার অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য মাতৃদুগ্ধ বিশেষজ্ঞ বা এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিতে পারেন। আপনার ত্বকের সঙ্গে শিশুর ত্বকের সংস্পর্শ এবং শিশুকে স্তনের কাছে রাখলে সে দুধ খাওয়া শিখে যাবে।
আপনি কি জানেন? শিশুদের দুধ খাওয়ালে মায়ের ডায়াবেটিস, স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সার, হৃদরোগ ও সন্তান জন্মদান-পরবর্তী মানসিক জটিলতার ঝুঁকি কমে?
৮. ভুল ধারণা? বুকের দুধ খাওয়াতে চাইলে কখনোই ফর্মুলা (বাজারে যেসব দুধ পাওয়া যায়) দেওয়া যাবে না।
বুকের দুধ খাওয়ানোর পাশাপাশি মায়েরা শিশুদের কখনো কখনো ফর্মুলা খাওয়ানোর কথা ভাবতে পারেন। সেক্ষেত্রে শিশুর ফর্মুলা বা সম্পূরক খাবারের বিষয়ে সঠিক, পক্ষপাতহীন তথ্য থাকতে হবে। বুকের দুধ তৈরি অব্যহত রাখার জন্য যত বেশিবার সম্ভব শিশুকে বুকের দুধ দিতে হবে। এ বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনার জন্য মাতৃদুগ্ধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বা দক্ষ পেশাজীবীর পরামর্শ নিতে হবে।
৯. ভুল ধারণা? অনেক মায়েরই শরীরে পর্যাপ্ত মাতৃদুগ্ধ থাকে না।
প্রায় সব মায়ের শরীরে তার শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় মাতৃদুগ্ধ তৈরি হয়। শিশুকে কতখানি সঠিকভাবে মায়ের বুকে সংযুক্ত করা গেল, কত ঘন ঘন দুধ খাওয়ানো হচ্ছে, এবং শিশুটি প্রতিবার কত ভালোভাবে মায়ের বুকের দুধ টেনে খেতে পারছে – এসবের ওপরও মাতৃদুগ্ধ তৈরি হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে। শিশুকে দুধ খাওয়ানো শুধু মায়ের একার কাজ নয়। এক্ষেত্রে মায়ের সহযোগিতা দরকার। যেমন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের কাছ থেকে নিয়মিত পরামর্শ, বাসায় অন্যদের থেকে সহযোগিতা এবং যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার ও পানীয় (পানিসহ) পানের মাধ্যমে সুস্থ্য থাকা।
১০. ভুল ধারণা? অসুস্থ মায়েরা দুধ খাওয়াতে পারবেন না।
এটা নির্ভর করবে অসুস্থতার ধরনের ওপর। তবে মায়েরা সাধারণত অসু্স্থ অবস্থায়ও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে পারেন। শুধু সেক্ষেত্রে মায়ের চিকিৎসা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও যথাযথ খাবার নিশ্চিত করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে মায়ের শরীরে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সক্রিয় থাকে, তা দুধ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে শিশুর শরীরেও সঞ্চারিত হয়, যা তার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা করে।
১১. ভুল ধারণা? দুধ খাওয়ানোর সময় ওষুধ সেবন করা যায় না।
মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর দিনগুলোতে যে কোনো ওষুধ সেবনের আগে অবশ্যই চিকিৎসককে অবহিত করতে হবে। এ সময় ওষুধ সেবনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়, মাত্রা মেনে খেতে হবে এবং সেক্ষেত্রে বিকল্প ওষুধ সেবনের প্রয়োজনীয়তাও থাকতে পারে। ওষুধ সেবনের আগে সে বিষয়ে শিশুর চিকিৎসককেও জানাতে হবে।
আপনি কি জানেন? শিশুরা প্রথম যে দুধ পায়, যাকে কলোস্ট্রাম বা শালদুধ বলা হয়, তা এন্টিবডি তৈরি করে এবং শিশুর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
১২. ভুল ধারণা? বুকের দুধ খাওয়া শিশুরা মায়ের সাথে আঁকড়ে থাকে।
সব শিশুই আলাদা। কেউ কেউ বেশি আঁকড়ে থাকে, কেউ কেউ থাকে না। তবে এর সঙ্গে তাদের মায়ের বুকের দুধ পানের কোনো সম্পর্ক নেই। মায়ের দুধ শিশুদের সবচেয়ে ভালো পুষ্টি যোগায়ই শুধু তাই নয়, শিশুর মস্তিষ্ক গঠনেও তা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও মায়ের দুধ পানের মধ্য দিয়ে শিশুর সঙ্গে মায়ের বন্ধন আরও জোরালো হয়।
১৩. ভুল ধারণা? এক বছরের বেশি পার হলে শিশুদের দুধ ছাড়ানো যায় না।
এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, এক বছরের বেশি বয়সের শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা যায় না। তবে এটি প্রমাণিত যে, দুই বছর পর্যন্ত দুধ খাওয়ানো শিশু ও তার মা উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক। প্রত্যেক মা ও শিশু আলাদা। তাদের ওপরই নির্ভর করবে কত দিন বুকের দুধ খাওয়ানো হবে।
১৪. ভুল ধারণা? কাজে ফিরলে শিশুকে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে।
অনেক মা-ই কাজে যোগদানের পরও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান। সেক্ষেত্রে প্রথমে দেখতে হবে আপনি যেখানে কাজ করেন সেখানকার নিয়ম-কানুন কেমন। অফিসে কাজের মাঝখানে যদি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর যথেষ্ট সময় ও সুযোগ থাকে, তাহলে হয়তো আপনি বাসায় গিয়ে শিশুকে দুধ খাইয়ে আসতে পারেন। অথবা পরিবারে কাউকে বা বন্ধুদের সাহায্যে শিশুটিকে ওই সময় আপনার কর্মস্থলে নিয়ে আসতে পারেন অথবা বুকের দুধ বোতলে সংগ্রহ করে বাসায় পাঠাতে পারেন। আর যদি আপনার কর্মক্ষেত্রে সেই সুযোগ না থাকে তাহলে যখন সময় করতে পারবেন, তখনই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান। আপনি যদি আপনার শিশুর জন্য বুকের দুধের বিকল্প কোনো খাবারের ব্যবস্থা করেও থাকেন, তারপরও সুযোগ পেলে বুকের দুধ চালিয়ে যাওয়া ভালো হবে। সূত্রঃ ইউনিসেফ বাংলাদেশ।