আয়াতুল কুরসীর অনুপম সৌন্দর্য
আসসালামু আ’লাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ!
অবলম্বন: আয়াত নম্বর ২৫৫, সুরা- আল বাকারা (২:২৫৫)
উদ্বোধন:
আমরা সবাই কমবেশি আয়াতুল কুরসী অর্থাৎ সুরা বাকারার ২৫৫ নম্বর আয়াতের ফজিলত, বরকত ও তাৎপর্যের কথা অবহিত। কিন্তু এই আয়াতে যে মহান সৃষ্টিকর্তার অনুপম কাব্যপ্রতিভা, নান্দনিক বাক্যবিন্যাস ও বাক্যবিন্যাসে অদ্ভুত সুন্দর সম্পর্ক রয়েছে তা অনেকেরই খুব একটা জানা নাই।
আয়াতুল কুরসী:
এই আয়াতে ০৯ টি বাক্যাংশ রয়েছে:
১। আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহুওয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যুম: আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নাই, তিনি চিরঞ্জীব (চিরস্থায়ী), সর্ব সত্তার ধারক (নিয়ন্ত্রণকর্তা);
২। লা তা খুজুহু সিনাতুও ওয়া লা নাউম: তাঁকে তন্দ্রা বা নিদ্রা- কোনকিছুই স্পর্শ করতে পারে না (চির অক্লান্ত, ক্লান্তিহীন);
৩। লাহু মা ফিস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ: আসমান-জমীনে যা কিছু আছে, সকল কিছুই মালিক (অধিকর্তা) একমাত্র তিনি;
৪। মানা যাল্লাযি ইয়াশফা’উ ইনদাহু ইল্লা বিইজনিহি: তাঁর অনুমতি (অনুগ্রহ) ব্যতীত কে আছে যে তাঁর কাছে সুপারিশ করবে;
৫। ইয়া’লামু মা বাইনা আইদিহিম ওয়া মা খলফাহুম: মানুষের সামনে ও পেছনে যা আছে সকল বিষয়েই তাঁর পূর্ণ জ্ঞান (জ্ঞাত);
৬। ওয়া লা ইউহি’তুনা বিশাইয়্যিম মিন ই’লমিহী ইল্লা বিমা শা’আ: তিনি যে বিষয়ে ইচ্ছা (অনুগ্রহ) করেন, যতটুকু ইচ্ছা (অনুগ্রহ) করেন, সে বিষয়ে ঠিক ততটুকু জ্ঞান ব্যতীত তারা আর বেশি কিছু অর্জন বা আয়ত্ব করতে পারে না;
৭। ওয়াসি’আ কুরসিয়্যুহুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ: তাঁর কুরসী সকল আসমান ও জমিন জুড়ে অপার বিস্তৃত;
৮। ওয়া লা ইয়া উদুহু হিফজুহুম: আর এ দু’টোর (আসমান ও জমিন) রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না;
৯। ওয়া হুওয়াল আলিয়্যুল আ’জীম: তিনি সুউচ্চ ও সুমহান।
বিভিন্ন বাক্যাংশের বিষয়বস্তু:
১ম বাক্যাংশ: আল্লাহর তাওহীদের পাশাপাশি তাঁর অবস্থা বা গুণবাচক দুইটি সিফাতি নাম উপস্থাপন করা হয়েছে।
২য় বাক্যাংশ: আল্লাহর ক্লান্তিহীনতা এবং ক্লান্তিজাত আলস্য বা তন্দ্রা বা নিদ্রাহীনতার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে।
৩য় বাক্যাংশ: আসমান-জমিন সর্বব্যাপী আল্লাহর উপস্থিতি, প্রভাব ও ক্ষমতার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
৪র্থ বাক্যাংশ: তাঁর নিকট সুপারিশ করার বিষয়ে আমাদের আল্লাহর একান্ত স্বেচ্ছাধীন অনুগ্রহ বা অনুমতির মুখাপেক্ষীনতার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৫ম বাক্যাংশ: আমাদের সকল ভূত-ভবিষ্যত, প্রকাশ্য, গোপন বিষয়াদি সম্পর্কে আল্লাহ সম্পূর্ণ পরিজ্ঞাত।
৬ষ্ঠ বাক্যাংশ: তার সেই জ্ঞান থেকে আমাদের অংশ সম্পর্কে আল্লাহর একান্ত স্বেচ্ছাধীন অনুগ্রহ বা অনুমতির মুখাপেক্ষীনতার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৭ম বাক্যাংশ: আসমান-জমিন সর্বব্যাপী আল্লাহর উপস্থিতি, প্রভাব ও ক্ষমতার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
৮ম বাক্যাংশ: আল্লাহর ক্লান্তিহীনতা এবং ক্লান্তিজাত আলস্যহীনতার বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
৯ম বাক্যাংশ: তাঁর দুইটি সিফাতি নাম উপস্থাপন করা হয়েছে।
সমঞ্জস ও সৌন্দর্য:
স্পষ্টতই লক্ষ্যণীয়, ১ম বাক্যাংশের সাথে ৯ম (১/৯), ২য় বাক্যাংশের সাথে ৮ম (২/৮), ৩য় বাক্যাংশের সাথে ৭ম (৩/৭), ৪র্থ বাক্যাংশের সাথে ৬ষ্ঠ (৪/৬) বাক্যাংশের বিষয়বস্তুগত অদ্ভুত এক অনুপম সামঞ্জস্য।
১ম থেকে ৪র্থ বাক্যাংশে ক্রমান্বয়ে আল্লাহর সিফাত; ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনা; রাজত্ব ও ক্ষমতা এবং স্বেচ্ছাধীন অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ঠিক ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম বাক্যাংশে বিপরীতক্রমে স্বেচ্ছাধীন অনুগ্রহ; রাজত্ব ও ক্ষমতা; ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা এবং তাঁর সিফাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মূল বিষয়বস্তু:
১ম থেকে ৪র্থ বাক্যাংশে একটি সত্ত্বার যেভাবে উপস্থাপন করা আদর্শ, তার সার্থক উপস্থাপন করা হয়েছে। কারো সম্পর্কে জানতে আমরা এভাবেই অগ্রসর হই:
১ম প্রশ্ন: তিনি কে (আল্লাহ, চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী, সকল সত্ত্বার ধারক)
২য় প্রশ্ন: তাঁর বৈশিষ্ট্য (ক্লান্তিহীন, তন্দ্রাহীন, নিদ্রাহীন)
৩য় প্রশ্ন: তাঁর ক্ষমতা বা প্রভাব (আসমান-জমিনে যা আছে সকল কিছুর রাজা)
৪র্থ প্রশ্ন: তাঁর সাথে আমাদের সম্পর্কের সুযোগ (তাঁর অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল)
ঠিক এভাবেই সার্থকভাবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে।
৫ম বাক্যাংশ:
স্পষ্টতই ৫ম বাক্যাংশ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী চারটি করে বাক্যাংশকে সন্ধিবদ্ধ করেছে।
৫ম বাক্যাংশের পূর্ববর্তী অর্থাৎ ৪র্থ এবং অনুবর্তী অর্থাৎ ৬ষ্ঠ- উভয় বাক্যাংশেই একদিকে তাঁর একান্ত স্বেচ্ছাধীন অনুগ্রহ বা করুণা, অন্যদিকে সেই অনুগ্রহের উপর আমাদের নির্ভরশীলতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
সমাপন:এই ধারাবাহিকতার মাহাত্ম্য-
১ম চারটি বাক্যাংশে প্রত্যাশিত ক্রমে স্বাভাবিকভাবে আল্লাহ তাঁর পরিচয়, তাওহীদ, বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা ও ব্যাপকতা, তাঁর সাথে আমাদের সম্পর্কের পরিচয় তুলে ধরেছেন। ৫ম বাক্যে এসে তিনি তাঁর সর্বব্যাপী ও সর্বগামী জ্ঞান-রাজত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমাদের প্রচ্ছন্নভাবে সতর্ক করে দিচ্ছেন। তারপর পুনর্বার বলছেন, আমিই সেই একমাত্র সর্বজ্ঞ, আমি তোমাদের সব জানি; রাজত্ব আমার, তোমরা আমার মুখাপেক্ষী; কোনকিছুই আমার ব্যবস্থাপনাকে বিচ্যুত করতে পারে না, আমাকে নিরস্ত করতে, বিরত করতে, ক্লান্ত করতে পারে না এবং আমিই সুমহান, সর্বশ্রেষ্ঠ।
অতএব, তোমরা কী করবে, কোথায় যাবে, কাকে উপাস্য মানবে? একমাত্র আমাকে ছাড়া!
আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
আসসালামু আ’লাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ!
সনির্বন্ধ অনুরোধ: এই অনুনিবন্ধগুলো কেবলমাত্র পূণ্যলাভের আশায় ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে শেয়ার করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। হয়তো আপনার শেয়ারের মাধ্যমে অন্য একজনও কেউ এ সকল বিষয় জানতে পারবে, আল্লাহর অনুগ্রহে তার মন, জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন হতে পারে, জ্ঞান বৃদ্ধি হতে পারে। আর তার সাথে আমরাও পূণ্যের অংশীদার হতে পারি। আমীন।