আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ মেয়েটি তার বাগদত্তাকে বলতে পারেননি, তার সঙ্গে কী হয়েছে। যন্ত্রণাদগ্ধ শরীর বহন করে বেঁচে থাকাও যেন জগদ্দল পাথরের মতো বোঝা।
সে বোঝা বয়ে চলার যাতনা ভোগার চেয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানানোই ভালো। কিন্তু আত্মহননের মতো ঘৃণিত কাজটি করতে গিয়েও পারেননি, বাধা পেয়ে ফিরে এসেছেন খিন এইচটুয়ের (ছদ্মনাম)।
মিয়ানমারের সেনাসদস্যদের ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বাড়ি ইয়া মায়েতে। এমন ধর্ষণ, নির্যাতন আর পুড়িয়ে মারার হৃদয়বিদারক ও রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন জান্তাবাহিনীর কয়েকজন সাবেক সদস্য।
এসব সেনাসদস্যের মুখ থেকে আসা যে নির্যাতনের তথ্য তুলে ধরেছে বিবিসি-তা মূলত গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে চলা মিয়ানমারের নিত্যদিনের চিত্র।
তাদের একজন বলেছেন, ‘সেনাকর্মকর্তারা আমাকে নিরীহ মানুষদের নির্যাতন, লুটপাট ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল।’ ভুক্তভোগী ও করপোরালসহ ছয়জন সৈন্যের সাক্ষ্য নিয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।
এ সৈন্যরা দলত্যাগ করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াইরত বেসামরিক মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর শিথিল নেটওয়ার্ক পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) একটি স্থানীয় ইউনিট সুরক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন। মিয়ানমারে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের চিত্র উঠে এসেছে সাবেক ওই সেনাদের মুখ থেকে।
মং ওও (ছদ্মনাম) একজন প্রহরী হিসাবে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ পেয়েছেন। এ বছরের মে মাসে একটি মঠে লুকিয়ে থাকা বেসামরিক লোকদের হত্যা করতে একটি ব্যাটালিয়নে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
তাদের আদেশ দেওয়া হয়েছিল সামনে যাকে পাওয়া যাবে, তাকেই মেরে ফেলতে হবে। এমন আদেশের কারণেই নিজের হাতে বয়স্ক, মহিলা ও কিশোরীকে হত্যা করেছিলেন মং।
গত বছরের ২০ ডিসেম্বরের কথা। তিনটি হেলিকপ্টার মধ্য মিয়ানমারের ইয়া মায়েত গ্রাম প্রদক্ষিণের পর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে সৈন্যদের নামিয়ে দেয়। এ সময় সেনারা দলে দলে ভাগ হয়ে গ্রামটির পুরুষ, নারী ও শিশুদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়।
মিয়ানমারের জঙ্গলের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অজ্ঞাত স্থান থেকে মং বলেন, ‘আমাদের কাছে নির্দেশ ছিল যা দেখবেন, তার ওপরই গুলি চালাবেন।’
তিনি জানান, কিছু লোক নিরাপদ জায়গা মনে করে একটি স্থানে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু সৈন্যদের দেখার পর তারা দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করেন। এমন সময় সেনারা তাদের ওপর গুলির বৃষ্টি বর্ষণ করেছিল।
সিপিএল অং স্বীকার করেছেন, তার ইউনিট গুলি করে পাঁচজনকে কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে আগুন লাগানোর নির্দেশ ছিল তাদের ওপর। সৈন্যরা কুচকাওয়াজ করে গ্রামের বাড়িঘরে আগুন জালিয়ে চিৎকার দিয়ে বলেছে, ‘জ্বালাও, পুড়িয়ে দাও।’ অং চারটি ভবনে আগুন ধরিয়ে দিলেন।
সাক্ষাৎকার দেওয়া সাবেক সেনাদের হিসাব অনুযায়ী সেদিন প্রায় ৬০টি বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করা হয়েছিল। থিহা বলেছেন, অভিযানের মাত্র পাঁচ মাস আগে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সে সময় তার বেতন ছিল মাসে দুই লাখ খাত (১০ হাজার ২০০ টাকা)।
আগুন দেওয়ার পর এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের কথা তিনি আজও ভুলতে পারছেন না। তিনি জানান, বাড়িতে আগুন লাগার পর লোহার দণ্ডের আড়ালে আটকে গিয়েছিল একটি কিশোরী। ওখানেই অসহায় অবস্থায় জীবন্ত পুড়ে মরল মেয়েটি।
থিহা বলেন, ‘মৃত্যুর আগে তার বাঁচার আকুতি, আর্তচিৎকার আমি ভুলতে পারি না। ওটা থেকে থেকে এখনো আমার কানে আঘাত করে। ১৫ মিনিটের মধ্যেই ছটফট করে মেয়েটি ছাই হয়ে যায়।’
বিবিসি খবর নিয়ে পরে জানতে পারে মেয়েটি ছিল অপ্রকৃতিস্থ। আগুন লাগানোর আগে বাড়ির লোকজন তাকে রেখেই পালিয়ে গিয়েছিল।
থিহা আরও জানান, ইয়া মায়েতে গ্রেফতার হওয়া একদল তরুণীর কথা। তাদের ধরে এনে অফিসার ছেড়ে দিলেন সেনাদের সামনে। বললেন, ‘তোমাদের যা ইচ্ছে, করো।’ থিহা নিজে মুখচোরা হয়ে আনমনা ঢং করেছিলেন।
মেয়েদের স্থানীয় একটি স্কুলে তিন রাত বন্দি করে রাখা হয়েছিল। প্রতি রাতে তাদের নেশাগ্রস্ত সেনারা চোখ বেঁধে ধর্ষণ করেছে।
তাদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে গিয়েছিল আশপাশের এলাকা। কিন্তু কী হবে-গ্রামের কোথাও কেউ নেই, আর থাকলেইবা কী! সেনাদের অস্ত্রের মুখে এ নির্যাতনের হাত থেকে তাদের কে বাঁচাবে?