ফরিদপুর প্রতিনিধি:
১৫ বছর ধরে বাড়ির একটি ঘরে কোমরে শিকল পরিয়ে আটকে রাখা হয়েছে ৩৫ বছরের রবিউলকে। শিকলবন্দী হয়ে রবিউলের কাজ হয়েছে দুই হাত দিয়ে মাটি খোঁড়া। এই মাটি খোঁড়ায় তাঁর চারপাশের জায়গাটা একটি গোলাকার বাংকারের রূপ নিয়েছে।
মাটির ওই বাংকারই এখন রবিউলের ঠিকানা। এখানেই তিনি খাওয়াদাওয়া করেন, প্রাকৃতিক কাজ সারেন। তবে সব কাজ তিনি করেন শিকলবন্দী অবস্থায়। তাঁকে দেখভাল করেন তাঁর মা আসমানি বেগম (৫৪)। একমাত্র মাকেই সহ্য করেন রবিউল। আর কেউ কাছে গেলে খেপে যান তিনি।
বাড়ির পশ্চিম প্রান্তে ৪২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট একটি চারচালা টিনের ঘর। ওই ঘরে রাখা হয়েছে রবিউলকে। একটি সুপারিগাছের সঙ্গে শিকলটি বাঁধা। সেই সুপারিগাছ ঘিরে গোল করে প্রায় ৬ ফুট গভীর গোলাকার মাটির গর্তে থাকেন রবিউল। এ গর্ত রবিউল হাতের আঙুল ও নখ দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে নিজেই তৈরি করেছেন। শিকলবন্দী জীবনে রবিউল নিজেই তৈরি করেছেন নিজের থাকার এ মাটির ঘর। গর্তটি একটি গোলাকার বাংকারেই মতো দেখতে।
রবিউলের পরিবার থাকেন ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের পশ্চিম চরবর্ণি গ্রামে। মধুমতী নদীর কাছের ওই গ্রামের দরিদ্র ভ্যানচালক মো. নুরুল মোল্লা (৫৮) ও আসমানি বেগম দম্পতির তিন ছেলে। এর মধ্যে রবিউল সবার বড়। মেজ ছেলের নাম ইমরান মোল্লা (৩১) ও ছোট ছেলের নাম এনামুল মোল্লা (২৩)।
আসমানী বেগম বলেন, শৈশবে দুরন্তপনায় রবিউলের জুড়ি মেলা ভার ছিল। খেলাধুলা করা, নদীতে সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানোয় তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না গ্রামে। কিন্তু ৯ বছর বয়সে এক জ্বর রবিউলের জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনে। তছনছ করে দেয় পুরো পরিবারটিকেই। আস্তে আস্তে হাত-পা শুকিয়ে যেতে থাকে। মুখের কথা হারিয়ে যায়। সাধ্যমতো অনেক কবিরাজ ও চিকিৎসককে দেখানো হলেও সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেননি রবিউল। ১৬-১৭ বছর বয়স থেকেই চূড়ান্তভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।
শীত বা গরম কোনো অনুভূতিই টের পান না রবিউল। শরীরেও রাখেন না কোনো বস্ত্র। একপর্যায়ে তাঁর আচরণ হয়ে পড়ে উন্মাদের মতো। মারধর করা, জিনিসপত্র ভাঙচুর করা যেন তাঁর নেশা হয়ে ওঠে। অবশেষে বাধ্য হয়ে তাঁকে শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়। এভাবে কেটে গেছে ১৫টি বছর।
স্থানীয় ময়না ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির মো. সেলিম বলেন, রবিউলের বিষয়টি তাঁর জানা আছে। রবিউল প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঝোটন চন্দ বলেন, রবিউলের খবরটি জানার পর তিনি তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে রবিউলের পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা ও খাদ্যসহায়তা দিয়েছেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে রবিউলের চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।