কক্সবাজার প্রতিনিধি:
বাল্যবিবাহ, একাধিক বিয়ে দ্রুত বর্ধমান জন্মহার, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে অনীহার কারণে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে জনসংখ্যা আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ৪ বছরে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ আশ্রয় শিবির এবং ভাসানচর মিলিয়ে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে এক লাখ ৩০হাজারের বেশি শিশুর জন্ম হয়েছে।
মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে সবচেয়ে বড় দলটি এসেছে ২০১৭ সালের আগস্টে। জাতিসংঘের হিসেবে অনুযায়ী ওই সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। অপরদিকে, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের নিবন্ধন অনুসারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ২০ হাজার ৫৮৬ জন। এ দলটি আসার আগে প্রায় সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম এসেছে বাংলাদেশে। তাদের প্রত্যাবাসনও শুরু হয়েছিল।
কিন্তু ১৯৯২ সালে প্রত্যাবাসন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর উখিয়া-টেকনাফের দুটি রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গার সরকারি পরিসংখ্যান দাঁড়ায় প্রায় ৩২ হাজারে। গত ২৫ বছরে ওই ৩২ হাজারের সঙ্গে নতুন ভূমিষ্ঠ শিশুর সংখ্যা যুক্ত হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার। এরা শিশু থেকে কৈশোর এবং কৈশোর থেকে যৌবন পেরিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নতুন নতুন পরিবার গড়ে তুলেছে এবং সে পরিবারগুলোতেও এসেছে অসংখ্য শিশু।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, অধিকাংশ পুরুষ রোহিঙ্গার একাধিক স্ত্রী রয়েছে। প্রতি স্ত্রীর ঘরে আসছে নতুন শিশু। বিষয়টি বিস্ময়কর হলেও সত্য। সূত্র জানিয়েছে, দেশের স্বাস্থ্য বিভাগে স্বাস্থ্য কর্মীদের মাধ্যমে প্রচলিত জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যাপারে তাদের আগ্রহী করা অসম্ভব একটি ব্যাপার। কারণ জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে এরা মহাপাপ হিসাবে মনে করেন। তাদের মতে মিয়ানমারের এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যতই বাড়বে ততই তাদের লাভ।
ফলে ধীরে ধীরে এ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বাল্যবিয়ের প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। ২০১৭ সালের পর ১০ থেকে ১২ বছরের যেসব শিশু ও কিশোরী কেউ একা বা কেউ পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল এদের অনেকেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। অনেকেই এখন একাধিক সন্তানের জননী।
অনুসন্ধানে আরো উঠে এসেছে, উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ শিবিরের ঝুপড়ি, কক্ষ, টাল (বস্তি) ইত্যাদিতে প্রতিনিয়ত ভূমিষ্ঠ হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশু। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালের পর থেকে হালনাগাদ অর্থাৎ গত চার বছরে ৩৪ শিবিরে জন্ম নিয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ২০০ রোহিঙ্গা শিশু। সে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নতুন এবং পুরনো রোহিঙ্গাদের নিয়ে এদেশে জন্ম নেয়া শিশুসহ রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখে পৌঁছেছে।
অপরদিকে, গত প্রায় চার বছরে ভারত থেকে স্থল, নৌ ও সাগর পথে এবং রাখাইন রাজ্য থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে এমন রোহিঙ্গার সংখ্যাও অর্ধ লাখের কাছাকাছি।
এসব রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন। তাদের পরিসংখ্যান ও কর্মকর্তাদের মতে, ৩৪ রোহিঙ্গা শিবিরে গড়ে প্রতিদিন ৯৫ শিশু জন্ম নিচ্ছে। সে অনুযায়ী ৩৪ শিবিরে মাসে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে গড়ে তিন হাজার শিশু। বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩৩ হাজার ৪০০। এরসঙ্গে একদিন পার হলেই নতুন করে যোগ হচ্ছে আরও ৯৫ জন শিশু।
আশ্রিত রোহিঙ্গা পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুদের বড় একটি অংশ বর্তমানে এদেশের জন্মনিবন্ধন ও তাদের পিতামাতার এনআইডি কার্ড প্রদর্শন করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নও করছে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
রোহিঙ্গা নেতা আবদুল করিম জানান, প্রতিবছর রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে সদস্য সংখ্যা যে বেড়েই চলেছে তা সত্য। আশ্রয় শিবিরে অনেক রোহিঙ্গা পরিবারে থাকার সঙ্কুলানও যে হচ্ছে না তাও সত্য। এছাড়া ৩৪ শিবির থেকে ইতোপূর্বে বহু রোহিঙ্গা পালিয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে ও বিদেশে।তারা চট্টগ্রাম কক্সবাজার সহ বড় একটি অংশ এদেশের বিভিন্ন স্থানে বসতি গেড়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ সংখ্যা বেশি। এরা পার্বত্য চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে।
রোহিঙ্গা নেতা ছালামত উল্লাহ জানিয়েছেন, মিয়ানমারে থাকাকালে দেশটির সেনাবাহিনী ও মগ সন্ত্রাসীদের ভয়ে অল্প বয়সে রোহিঙ্গা কিশোরীদের বিয়ে দেওয়ার প্রচলন একটি নিয়মে পরিণত হয়ে আছে। বাংলাদেশে আসার পরও সে প্রচলন অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া এক পরিবারে সদস্য সংখ্যা যত বেশি থাকবে, তত বেশি সরকারি, বেসরকারি ত্রাণ বা রেশন সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি তাদের জন্য আকর্ষণীয় একটি ব্যাপারে পরিণত হয়ে আছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম জাতীয় কমিটির সভাপতি আতা উল্লাহ খাঁন জানান, রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে নতুন নতুন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রক্রিয়াটি সামাল দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কেননা, তাদের শীর্ষ পর্যায়ের এবং পরিবারের কর্তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে এ জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে সন্তান ভূমিষ্ঠ করে তা বাড়ানো। এখন তাদের মিয়ানমারের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকে।
তিনি আরো জানান, একদিন তারা বিশাল একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে-এ আশা প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবার নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে। মূলত এ বিশ্বাস থেকেই এরা অল্প বয়সের বিয়ে দিয়ে থাকে। আবার অনেক পুরুষ রোহিঙ্গা একাধিক বিয়ে করে সন্তান সংখ্যা বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে।