সন্তানের জন্য মা সব করতে পারেন। আর তা-ই যেন করে দেখিয়েছেন মিসেস মোমেনা বেগম। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি হাল ছাড়েননি। বাড়ি বিক্রি করে চার মেয়েকে পড়িয়েছেন মেডিকেলে। আজ তারা ডাক্তার।
১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় জন্মগ্রহণ করেন মোমেনা বেগম। বেড়ে ওঠা সন্দ্বীপে, সেখানেই তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে মো. কামালউদ্দিনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। একপর্যায়ে পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে এসএসসির পর তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।
পরে পরিবারের হাল ধরতে কামালউদ্দিন পাড়ি জমান ওমানে। এ সময় মোমেনাকে পরপর দুটি কন্যাসন্তান জন্ম হওয়ায় কারণে মুরুব্বীদের কাছ থেকে শুনতে হয় বঞ্চনা। তারপর তিনিও চলে যান স্বামীর কাছে ওমানে। সেখানে চাকরির পাশাপাশি হোম স্কুলিং শুরু করেন।
এতে দুজনার আয়ে ভালোই চলছিল সংসার। এর মধ্যে জন্ম হয় আরও দুই কন্যাসন্তানের। এতেই যেন নেমে আসে নরক। প্রতিনিয়ত সবার থেকে কথা শুনতে হতো, ‘সব মাইয়্যা হলো, শেষ বয়সে দেখবে কে? মরলে খাটিয়া ধরবে কে?’
তবুও এসব টিপ্পনীতে কান দেননি মোমেনা। বড় করতে থাকেন চার কন্যাসন্তানকে। এর মধ্যেই হঠাৎ চাকরি চলে যায় স্বামীর। এ সময় সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালানো, শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য বাড়িতে টাকা পাঠানো সব মিলিয়ে জীবন হয়ে পড়ে কঠিন। পরে বাধ্য হয়ে হালিশহরে থাকা বাড়িটি বিক্রি করে দেন মোমেনা। চলতে থাকে চার কন্যার উচ্চমাধ্যমিক জীবন।
কষ্টের ফল বৃথা যায়নি মোমেনার। বড় মেয়ে কামরুন নাহার দিনাজপুর সরকারি মেডিকেলে, মেজো মেয়ে হুমায়রা তাহাস্সুম কুমিল্লা মেডিকেলে, সেজো মেয়ে জান্নাতুন নাঈমও কুমিল্লা মেডিকেলে এবং ছোট মেয়ে নিগার সুলতানা ঢাকা মেডিকেলে পড়াশোনা শেষ করেন।
বিসিএস (স্বাস্থ্য) শেষে প্রথমে পোস্টিং হয় সেই সন্দ্বীপে। পরে মেয়েদেরকে সেখানেই ফেরত পাঠালেন মোমেনা। যেখানে তাকে শুনতে হতো, ‘মেয়েরা পড়াশোনা করে কি হতে পারবে?’ হ্যাঁ, মোমেনা বেগম পেরেছেন। দেখিয়েছেন শত বাধা ও প্রতিকূল অবস্থায়ও হাল ধরে কি করে সমুদ্র জয় করতে হয়।
তারই স্বীকৃতিস্বরূপ রোববার (১২ মে) ‘আরটিভি স্বপ্নজয়ী মা সম্মাননা ২০২৪’ পেয়েছেন মোমেনা বেগম।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, সর্বপ্রথম মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। সবসময় গৃহিণী হিসেবে ছিলাম, ভাবিনি এ রকম মঞ্চে কখনো আসবো। শুধু ইচ্ছে ছিল মেয়েদেরকে মানুষ করবো। কারণ, আমাদের সমাজে মেয়েরা অনেক অবহেলিত। এটা আমি নিজের চোখেই দেখেছি।
মোমেনা বেগম আরও বলেন, আমি নিজে লেখাপড়া করতে পারিনি। সেজন্য আমার ভেতরে একটা চাপা কষ্ট ছিল। ওইটা আমি আমার মেয়েদের মাধ্যমে করতে পেরে আনন্দিত। খুবই উচ্ছ্বসিত।
এ সময় মোমেনার সেজো মেয়ে ডা. জান্নাতুন নাঈম বলেন, আম্মু সবসময় পর্দার আড়ালে ছিলেন। কখনও সামনে আসতে চাননি। কিন্তু আমি আসলে কি ভেবে যেন আম্মুর পুরো জার্নিটা একটা ডক্টরস গ্রুপে শেয়ার করেছিলাম। সেটা যে এত রেসপন্স পাবে, এতদূর আসবে এটা আসলে আমি নিজেও চিন্তা করিনি।
তিনি আরও বলেন, দূরদর্শিতা-বিচক্ষণতা এই বিষয়গুলো আমার আম্মুর মধ্যে খুব বেশি ছিল। আজকে দাঁড়িয়ে আগামী ১০ বছরের পরিকল্পনা উনি করতে পারেন। উনি দেখতে চেয়েছেন উনার মেয়েরা সবচেয়ে বড় পজিশনে যাবে, বড় বড় ডিগ্রিগুলো উনার মেয়েদের হবে। সবাই বিসিএস ক্যাডার হবে। এই ব্যাপারগুলো যে উনি নব্বই সালে বসে চিন্তা করেছেন, আমি এই জায়গায় ২০২৪ সালে এসেও চিন্তা করতে পারিনা। তাই বলবো, সবকিছুর ক্রেডিট আমার মায়ের। সঙ্গে আব্বুরও। তবে মায়ের কথা আমি সবসময় বলবো। আমি যেন আমার আম্মুর মতো একজন মানুষ হতে পারি, সবাইকে এ রকম একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে পারি।