নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল ॥
সময়ের আলোচিত ঘটনা বরিশালের উজিরপুর মডেল থানায় হত্যা মামলার নারী আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের ঘটনা। সম্প্রতি এ ঘটনায় থানার ওসিসহ দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি একজন সার্কেল এএসপি এবং থানার ওসিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ওই নারী। ঠিক সেই মুহুর্তে রিমান্ডে নিয়ে যৌন নির্যাতনের ঘটনাটি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। কেননা নারীর করা যৌন নির্যাতনের অভিযোগের সত্যতা মেলেনি মেডিকেল রিপোর্টে। এমনকি আঘাতের যে চিহ্ন দেখা গেছে তাও অনেক পুরানো বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই রিপোর্টে। গত ৩ জুলাই শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আদালত এবং পুলিশের কাছে পাঠানো মেডিকেল রিপোর্ট থেকে এই তথ্য জানা গেছে। শেবাচিমের গাইনী বিভাগের ইউনিট-২ এর ইন্ডোর মেডিকেল অফিসার মিনতি বিশ্বাস ওরফে মিতু অধিকারীর এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন।
গত ২৮ জুন ওই নারীকে একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে উজিরপুর থানায় নিয়ে যাওয়ার পরপরই এক নারী পুলিশ সদস্য লাঠি দিয়ে তার ওপর নির্যাতন চালান। পরে উপস্থিত অন্য পুলিশ সদস্যরাও তাকে লাঠি দিয়ে মারধর করেন। তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয় এবং ২৯ জুন তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
আদালতে ওই নারী আসামি অভিযোগ করেন, ২৯ জুন রিমান্ডে নেওয়ার পর তাকে মারধর না করা হলেও পরের দিন সকালে তাকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কক্ষে পাঠানো হয়। সেখানে তার ওপর যৌন নিপীড়ন চালানো হয়। এরপর এক নারী পুলিশ সদস্যকে ডেকে নিয়ে তাকে আবার লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে তদন্ত কর্মকর্তা নিজেই তাকে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে পেটান। তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফেরার পর তিনি নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় দেখতে পান।
আদালত অভিযোগ শুনে ওই নারীকে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান এবং তাকে নির্যাতনের বিষয়ে ২৪ ঘন্টার মধ্যে মেডিকেল প্রতিবেদন দিতে বলেন শেবাচিম হাসপাতাল পরিচালককে। নির্দেশ অনুযায়ী গত ৩ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে পাঠান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
শেবাচিম থেকে পাঠানো ওই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে দুই কনুই, গোড়ালিসহ ৬টি স্থানে ৬ থেকে ৮টি আঘাত রয়েছে। তবে সবগুলোই অনেক পুরানো আঘাত। সবমিলিয়ে আঘাতের গুরুত্ব সিম্পল (নরমাল) বলে মেডিকেল রিপোর্টে রোগীর ইতিহাসে উল্লেখ করেছেন চিকিৎসক। অবশ্য আঘাতগুলো কতটা পুরানো সে বিষয়ে উল্লেখ নেই তদন্ত প্রতিবেদনে।
রিপোর্টের বিষয়ে জানতে চাইলে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ.এম সাইফুল ইসলাম বলেন, আদালত নির্দেশে দিয়েছে একজন নারী চিকিৎসক দিয়ে ওই ভিকটিমের পরীক্ষা করে ২৪ ঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট দিতে। নির্দেশনা অনুযায়ী নারী চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। ওই চিকিৎসক মেডিকেল রিপোর্ট খামে ভরে আমাকে দিয়ে গেছেন। তিনি যেভাবে দিয়েছেন সেভাবেই আদালতে পাঠিয়েছি। সুতরাং রিপোর্টে কি আছে সেটা আমার দেখার সুযোগ হয়নি।
অপরদিকে, স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিতে গিয়ে অভিযোগকারী নারীর বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাথ্য বেরিয়ে আসে। নাম গোপন রেখে তার কয়েকজন প্রতিবেশী জানিয়েছেন, ইতোপূর্বে মিতুর আরও দুজন স্বামী ছিল। কিন্তু তাদের সাথে মিতুর কোন যোগাযোগ নেই। মিতু বাবা-মায়ের পরিবার ছেড়ে জামবাড়ি গ্রামে ৫০০ টাকায় ঘর ভাড়া নিয়ে একা বসবাস করেন। বাসুদেব নামে যাকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে তার সাথে দীর্ঘ দিন ধরেই পরকীয়ার সম্পর্ক চলে আসছিল মিনতির। বাসুদেব একসময় ট্রাক চালক ছিলেন। পরকীয়ার সূত্র ধরে বাসুদেব এর কাছ থেকে অনেক অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি বাসুদেব ট্রাক চালোনার কাজ ছেড়ে দেন। এর পর থেকেই দুজনের মধ্যে সম্পর্কের ফাঁড়াক সৃষ্টি হয়।
বরিশাল জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান হোসেন বলেন,‘একজনের নামে অভিযোগ আসতেই পারে। কিন্তু সব অভিযোগ কি সত্য হয়? অবশ্যই অভিযোগের প্রমাণ থাকতে হয়। তার পরেও আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী উজিরপুরের দুই ওসিকে ক্লজড করা হয়েছে। একজন এএসপি এবং দুজন ওসিসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ডিআইজি কার্যালয় থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি এই ঘটনায় বিভাগীয় মামলা হয়েছে। আশা করছি সুষ্ঠু তদন্তে সবকিছু পরিস্কার হবে। আমাদের কোন অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিললে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।