ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ
আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের খবরে উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠিতে বইছে আনন্দের বন্যা। কাঙ্খিত এ সেতুর রূপকার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এ জেলার সর্বস্তরের মানুষ। ব্যবসা-বনিজ্যসহ সর্ব ক্ষেত্রে উন্মোচিত হবে এক নতুন দিগন্ত। বিশেষ করে ঝালকাঠির বিসিক শিল্প নগরীসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণীর শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার পাশাপাশি পেয়ারা, আমরা, শীতল পাটি, আটা-ময়দা ও লবন যাবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। এতে যেমন খুশি কৃষক, তেমনি ব্যবসায়ীরাও। ইতিমধ্যেই জেলার নদী ও সড়ক যোগাযোগের সুবিধাজনক স্থানে অনেক শিল্প উদ্যোক্তাই জমি কিনতে শুরু করেছে। এছাড়াও আগে যেখানে ঝালকাঠি থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগতো ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা, তাও কমে তিন থেকে চার ঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে।
জানা যায়, সুগন্ধা, বিষখালী, গাবখান, বাসন্ডা নদীর তীরে প্রাচীন সভ্যতার জনপদ ঝালকাঠি। বৃটিশ আমলে কলকাতার সঙ্গে একযোগে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালিত হওয়ায় দ্বিতীয় কোলকাতা নামেও জেলা শহর পরিচিত। ব্যাবসা বানিজ্য আর কৃষি নির্ভর অর্থনীতির এ জেলা পেয়ারা, আমড়া, লেবু, কলা ও শীতলপাটির জন্যও বর্তমানে দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানকার লবন, আটা-ময়দা, সরিষার তেল আর পেয়ারা-আমড়ার উৎপাদন এতদিন নদী পথেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে আসছিল। ঢাকাসহ অন্য জেলা থেকে বেশিরভাগ পণ্যও আসত নদী পথেই। সময় ক্ষেপণ, ফেরিতে আটকা পড়া, পণ্য পঁচে যাওয়া সহ নানা প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও ঢাকার সাথে যোগযোগ ছিলো দীর্ঘ সময়ের। কিন্তু পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মাধ্যমে সব প্রতিবন্ধকতার অবসান ঘটবে বলে জেলাবাসীর মুখে এখন হাসি।
ঝালকাঠি জেলা সদর থেকে লঞ্চ বা বাসযোগে ঢাকা পৌঁছাতে সময় লাগতো ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা। আবার কখনও ফেরীঘাটে যানজটের কারনে সময় আরো বেড়ে যায়। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হলে মাত্র পাঁচ মিনিটে বাসযোগে সেতু পাড়ি দিয়ে তিন থেকে চার ঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে ঢাকা। তাই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছে দক্ষিণের জেলা ঝালকাঠির সাত লাখ মানুষের নানা স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে নিয়ে চলছে আলোচনা। কৃষি পণ্য সরবরাহসহ নানা কাজে জেলাবাসীর সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ প্রাচীন কাল থেকেই। তবে পদ্মা সেতু চালু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো সহয হবে বলে প্রত্যাশা সবার।
ডুমরিয়া গ্রামের আমড়া চাষী সুনিল হালদার বলেন, এ অঞ্চলে পেয়ারার সঙ্গে কৃষকরা আমড়া, লেবু, কলাসহ নানা ধরনের সবজির চাষ করে থাকেন। সবজি ঝালকাঠিতে স্থানীয়ভাবে বিক্রি হয়ে গেলেও আমড়া, লেবু, কলা এবং ডাব চালান হয় ঢাকায়। পদ্মা সেতু চালু হলে এসব চাষের সঙ্গে জড়িতরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। চাষিদের সঙ্গে লাভবান হবেন খুচরা ও পাইকারী বিক্রেতারা। পদ্মা সেতুর কারনে ঝালকাঠির এই বিল অঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার মানে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার ডহরশংকর গ্রামের অসিম চন্দ্র দে (৩৭) বলেন, শীতল পাটি তৈরি করে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে কোন রকমের সংসার চলে আমাদের। এখন পদ্মা সেতু হলে নিজেরাই ঢাকায় নিয়ে বড় বাজারে ও দোকানগুলোতে পাটি বিক্রি করতে পারবো। সকালে পণ্য নিয়ে ঢাকায় গিয়ে বিক্রি করে রাতেই বাড়িতে ফিরে আসতে পারবো। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি পদ¥া সেতু নির্মাণ করায় আমাদের ব্যবসা প্রসারিত হবে। এখন আর না খেয়ে থাকতে হবে না।
শীতল পাটির কারিগর অসিম চন্দ্র দে বলেন, চট্টগ্রামে জব্বারের বলি খেলাসহ দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও মেলায় আমাদের তৈরি লাখ লাখ টাকার শীতলপাটি বিক্রি হয়। কিন্তু আমরা সরাসরি বিক্রি করতে পারি না। পাইকারি বিক্রি করতে হয়। এখন পদ্মা সেতু হচ্ছে, আমরা অল্প সময়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে নিজেরাই শীতলপাটি বিক্রি করতে পারবো।
ঝালকাঠি সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. বাহাদুর চৌধুরী বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে ঝালকাঠি জেলার বাস শ্রমিকদের আয় বৃদ্ধি পাবে। এখন ঝালকাঠির শ্রমিকরা শুধু দিনের বেলা ডিউটি করে থাকে। কারন রাতের বেলা আমাদের বাস বন্ধ থাকে। সেতু চালু হলে আমাদের রুটের বাসগুলো ঢাকায় যাতায়াত করতে পারেব। সেতু চালু হলে সড়কপথে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী পরিবহনের খরচ কমবে যার ফলে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কমবে বলে আশা করা যায় । সেতুর কারনে ঝালকাঠি বাস টার্মিনালের পরিধি বৃদ্ধি পাবে। বাসটার্মিনালের কারনে এই ব্যবসা বানিজ্য সম্প্রসারণ ঘটবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য আজকে আমরা পদ্মা সেতু পেয়েছি, আমি জেলাবাসীর পক্ষ থেকে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ঝালকাঠি জেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিলন মাহমুদ বাচ্চু বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে ঝালকাঠি জেলার মানুষের সঙ্গে বাস মালিকরাও উপকৃত হবে। এখন আমাদের বাসগুলো শুধু লোকাল যাত্রী পরিবহন করে। সেতু চালু হওয়ার পর আমাদের সমিতির বাস ঢাকার পথেও যাত্রী পরিবহন করবে। এতে আমাদের মালিকরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। ঢাকা- ঝালকাঠি রুটে যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। রাতদিন ঢাকার পথে মানুষ আসা যাওয়া করবে। সে কারনে বাসের চাহিদা বাড়বে। নতুন নতুন বিনিয়োগকারীরা যাত্রী পরিবহনখাতে অর্থ বিনিয়োগ হবে। বাস শ্রমিকদের বেকারত্ব দূর হবে।
ঝালকাঠি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মু. মনিরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ঝালকাঠি জেলার ব্যবসায়ীদের জন্য পদ্মা সেতু একটি মহা আর্শিবাদ। পদ্যা সেতু চালু হওয়ার কারনে ঢাকার সাথে সড়ক পথে যোগাযোগের দূরত্ব কমবে ৯০ কিলোমিটার। সময় কমবে কয়েক ঘণ্টা। ঝালকাঠির ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে লবন, রড, সিমেন্ট ও টিন ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবে সবচেয়ে বেশী। ঝালকাঠিতে এক সময় ৪০ টি লবনের মিল ছিল। যার মধ্যে বর্তমানে ১০-১২ টি চালু আছে। পদ্মা সেতুর প্রভাবে বন্ধ হওয়া লবন মিল গুলো চালু হলে ব্যবসায়ীরা খুব বেশী লাভবান হবে।
ঝালকাঠির বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সালাহউদ্দিন আহম্মেদ সালেক বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে আমাদের জেলায় শিল্প কারখানা বেড়ে যাবে। উদ্যোক্তাও বাড়বে। আগে ঢাকায় গিয়ে এখানকার মানুষ চাকুরি করত, এখন ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ ঝালকাঠিতে চাকুরি করতে আসবে।
ঝালকাঠি পৌরসভার মেয়র মো. লিয়াকত আলী তালুকদার বলেন, এক সময় ঝালকাঠিকে দ্বিতীয় কোলকাতা বলা হতো। পদ্মা সেতু চালু হলে পুরনো ঐতিহ্য ফিরে আসবে। আবারো ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধি লাভ করবে ঝালকাঠি। মানুষের আয়ের বিভিন্ন পথ সৃষ্টি হবে। বেকারত্ব কমে আসবে। বেশি বেশি উন্নয়ন হবে। সব কিছুতেই ঝালকাঠির মানুষ সুবিধা পাবে।
ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন হবে। ঝালকাঠি থেকে আমরা অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবো। এটা মানুষের দীর্ঘ দিনের একটি স্বপ্ন ছিল, তা পূরণ হতে চলছে। এর ফলে এলাকার কৃষি পণ্য সহযেই ঢাকায় পৌঁছে যাবে। শিল্প কলকারখানা বেড়ে যাবে। সব শ্রেণির মানুষের উপকার